• ২৭শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২রা সফর, ১৪৪৭ হিজরি

মাদকমুক্ত সমাজই হোক তারুণ্যের অহংকার: আফতাব চৌধুরী

দৈনিক সোনালী সিলেট
প্রকাশিত জুন ২৩, ২০২৫
মাদকমুক্ত সমাজই হোক তারুণ্যের অহংকার: আফতাব চৌধুরী

তরুণরাই দেশ, জাতি ও সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র, আগামী দিনের কর্ণধার। তরুণরাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জাতির মূল চালিকাশক্তি। তরুণ প্রজন্মই আমাদের দেশ-জাতিকে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে টেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে এবং রেখে আসছে যুগ যুগ ধরে। তবে আমাদের দেশের তরুণ ও যুব সমাজের একাংশ নানাভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে মারণ নেশা মাদকের
সঙ্গে। এ নেশা এমনই এক নেশা যা ধীরে ধীরে বিবর্ণ করে দিচ্ছে আমাদের সবুজ তারুণ্যকে। নষ্ট করে দিচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ।
আমাদের দেশে রয়েছে পর্যাপ্ত তারুণ্য নির্ভর জনশক্তি। দেশের এ মূল্যবান সম্পদ মাদকের চোরাচালান ও অপব্যবহারের কবলে পড়ে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি দেশের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হয়, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। নেশার ছোবলে পড়ে এ যুবসমাজ কর্মশক্তি, সেবার মনোভাব ও সৃজনশীলতা হারিয় দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করছে। দেশ গড়ার কারিগর সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে মাদক। মাদকের কারণেই বুক ফাটা কান্নায় পৃথিবীর আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা কমপক্ষে ৬০ লাখ। কোনো কোনো সংস্থার মতে ৭০ লাখ। নব্বইয়ের দশকে যার পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ১০ লাখেরও কম। মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের ৪৩ শতাংশ
বেকার, এদের ৫০ শতাংশ নানারকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিল তাদের অধিকাংশই এখন ইয়াবাতে আসক্ত। সম্প্রতি ইয়াবা আমাদের দেশের তরুণ ও যুবসমাজকে গ্রাস করে চলেছে।
এদিকে প্রতিদিন যেমন ইয়াবা আটক করা হচ্ছে, একই সাথে জড়িতদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। এপরও প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা তরুণরা গ্রহণ করছে। আমাদের তরুণরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তরুণদের সঙ্গে তুলনা করলে কোনো অংশেই মেধা, মনন ও উন্নত চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে কম নয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তারা আজ বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। এক কথায় নিজ দেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা ভালো অবস্থান দখল করে আছে, তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নতুন নতুন আবিষ্কার করে চমকে দিচ্ছে বিশ্বকে। আমাদের এসব অগ্রগতি-গৌরবকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে কতিপয় দেশ পিছনে লেগে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব দেশ বিভিন্ন অপকৌশলে আমাদের তরুণ সমাজের ভিতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে এমন ক্ষতিকর অপসংস্কৃতি যা আমাদের সন্তানদের মেধাকে ধ্বংস করে বিপথগামী করার পাশাপাশি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দিচ্ছে। মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসা ও ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ের পর্যবেক্ষণ- ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তবে আরও বেশ কয়েকটি বেসরকারী সংস্থার
তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে। অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদকদ্রব্যের কারনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে দিনে দিনে। তাই অপরাধ হ্রাস করতে গেলে অবশ্যই মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। অন্যথায় দিন দিন অপরাধ বাড়তেই থাকবে। মাদক ব্যবসা ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা বেশি এবং বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে তরুণ সমাজ এদিকে ঝুঁকছেও বেশি। এই ভয়াল মাদক তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া, মনুষ্যত্ব সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে, বিনষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ-মায়া, ভালোবাসা ও পারিবারিক বন্ধন। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার একমাত্র মেয়ে মাদকাসক্ত হয়ে বাবা-মাকে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করেনি। নিজ সন্তান শুধু মাদকে আসক্ত হওয়ার কারণেই জীবন দিতে হয়েছে নিজ সন্তানের হাতে বাবা-মাকে। ইয়াবায় আসক্ত সন্তানের হাতে বাবা-মা, ঘনিষ্ঠ স্বজন নির্মম হত্যার শিকার হচ্ছেন। নেশাখোর বাবা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার ক্রোধে নিজ সন্তানকে খুন করছেন। নেশার টাকা না-পেয়ে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে হত্যা করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার মত অমানবিক ঘটনাও ঘটে চলেছে বর্তমান সমাজে। আমরা জানি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাদকের বিরুদ্ধে ছিলেন অত্যন্ত সজাগ এবং সচেতন যার ফলে তার শাসনামলে মাদক ব্যবসা এবং সেবনকারীদের তৎপরতা ছিল কম। আশার কথা তাঁর তনয়া শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্ছার। তার স্পষ্ট বক্তব্য মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দস্তরমতে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং এও বলেছেন মাদক বিরোধী যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে- সমাজ তথা জাতীয় স্বার্থে তরুণ প্রজন্মই মাদক ও মাদকাসক্তি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। তারাই পারবে দেশকে মাদকমুক্ত করতে। এজন্য তরুণ-যুবকদের শুধু মাদকবিরোধী কার্যাবলিতে অংশ নিলেই চলবে না, বরং প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহুর্ত মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মাদকের পাচার রোধ ও এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জাতিসংঘ মাদকবিরোধী সংস্থা ‘বিশ্বব্যাপী মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা’র জন্য বিশেষ কার্যক্রম চালু করেছে। মিডিয়াকে এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে হলে তাদের জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকা- ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রাখা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারাগুলো সময়োপযোগী করে এর যথাযথ প্রয়োগ ও কঠোর বাস্তবায়ন করা গেলে মাদকের অপব্যবহার অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। মাদক-ব্যবসায়ীরা দেশ ও জাতির বড় শক্র। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মাদকাসক্তির অভ্যাস নির্মূলের জন্য যুবসমাজের একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। তাই মাদকমুক্ত সমাজই হোক তারুণ্যের অহংকার। প্রবীণ সাংবাদিক। সদস্য-সিলেট জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও প্রচার কমিটি।