সোনালী ডেস্ক:
রান্নাঘরের তেলের বোতল, পানির বোতল, মগ, বালতি, বিস্কুটের প্যাকেট, চায়ের প্যাকেট, মশলার প্যাকেট থেকে শুরু করে চেয়ার টেবিল, টুল, টেবিল, ঢাকনা, তালা, গ্লাস, বাটি, চামচ, টিফিন বক্স, ঘরের দরজা-জানালা, ইলিকট্রিক পাখা, ছাতারবাট, গায়ের বর্ষাতি, পায়ের চপ্পল, জুতো গাড়িতে বসার সিটের স্পঞ্জ, ফোম, ঢাকনা, কোথায় নেই প্লাস্টিক। আছে চশমার
ফ্রেমে, কলমের শরীরে, কম্পিউটারে , ল্যাপটপে, শার্ট-পেন্টের বোতামে, চেনে, কোমরের বেল্টে, ঘড়ির বেল্টে, চিরুনিতে, হাতের স্টিকে, ঔষুধের প্যাকেটে, ঔষুধের বোতলে, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে, ছোট বড় পানির পাইপে। বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে প্লাস্টিক সামগ্রী বিভিন্ন আকৃতিতে, বিভিন্ন প্রকৃতিতে। প্রতি বছর ত্রিশ কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরী হচ্ছে পৃথিবীতে। এক হিসেবে দেখো গেছে গত এক দশকে বিশ্বে যত প্লাস্টিক দ্রব্য তৈরি হয়েছে, তার আগের একশো বছরেও তা হয়নি। ওজনে হালকা, বহনে সহজ, প্রয়োজনে সহজেই যত্রতত্র নিয়ে ব্যবহার করা যায়, দামেও সস্তা। পলিথিনের একটি ছোট্ট প্যাকেট ভাঁজ করে বুক পকেটে পুরে সাহেব সেজে বাজারে গিয়ে দুই-তিন কেজি ওজনের শাক-সবজি বা মুদির
দোকানের সামগ্রী নিয়ে সহজেই বাড়ি ফেরা যায়। এই ভাবে হাজার রকমের সুবিধা রয়েছে প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহারে। তাই এই যুগকে প্লাস্টি যুগ বললে নিশ্চয়ই বেশি বলা হবে না। অবশ্য ইতিহাসের লৌহ যুগ বা তা¤্রযুগের মত প্লাস্টিক যুগ কিন্তু মানবসভ্যতার অগ্রগতি নিশান উড়িয়ে যাচ্ছে না মোটেই বরং বিপরীত কাজটি করে যাচ্ছে অহরহ। প্লাস্টিক শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘প্লাস্টিকস, থেকে। প্লাস্টিকস-এর অর্থ ছাঁচে ফেলা বস্তু। সহজ করে বলা যায়, ছাঁচে ফেলে ইচ্ছামতো আকৃতি দিয়ে বানানো বস্তু। আরও সহজ করে হয়তো বলা যাবে যে, বস্তুকে ছাঁচে ফেলে ইচ্ছামতো আকৃতি দিয়ে পছন্দের দ্রব্যটি বানিয়ে নেওয়া। উপরে উল্লেখিত দ্রব্যসামগ্রীর প্রতি একটু মনোযোগ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেব। রাসায়নিক বিচারে প্লাস্টিক একটি পলিমার। পলি শব্দের অর্থ বহু, মার শব্দের অর্থ একক। অর্থাৎ কোনো বস্তুর একককে রাসায়নিকভাবে বহু সংখ্যায় যুক্ত করে নিজে তাকে বড় আকার দেওয়া। আবার একটি মাত্র বস্তুর একক ব্যবহার করে কিন্তু প্লাস্টিকের যাবতীয় দ্রব্য তৈরি হচ্ছে না। অনেকগুলো বস্তুর একক ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্যের প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এইসব বস্তুর মধ্যে আছে ইথলিন, প্রোপাইলিন,বিউটেন, স্টাইরিন ইত্যাদি। কী বস্তুটি বানানো হবে, সেই বিচারেই ববহৃত বস্তু নির্বাচন করা হয়। আবার বস্তুটির সাথে মনমতো রং
মিশিয়ে বানানো বস্তুটির রং দেওয়া হয়। প্লাস্টিক মূলত খনিজ তেল, অর্থাৎ পেট্রোলিয়াম থেকে প্রস্তুত করা একটি বস্তু। যাঁদের বয়স পঞ্চাষ-ষাট বছর বা তার থেকে বেশি, তাঁরা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন, তাঁদের ছোটবেলায় প্লাস্টিক সামগ্রীর এমন ছড়াছড়ি ছিল না কোথাও। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর মাটির নিচে
প্রকা- সব খনিজ তেলের ভা-ার আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই প্লাস্টিকের তৈরি সামগ্রী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। খনিজ গ্যাস থেকেও প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুত করা হয়। আবার একশো বছর আগেও প্লাস্টিকের দ্রব্য প্রস্তুত করা হত। কিন্তু তার পরিমাণ ছিল নিতান্তই স্বল্প। সেই পরিমাণ ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না। কিন্তু এখন গোটা চেহারাটাই পালটে গেছে। একটি হিসাবে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত এক হাজার কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক দ্রব্য রয়েছে পৃথিবীতে। ব্যবহারের পরে এসব সামগ্রীর প্রায় সাড়ে ছ’শো কোটি মেট্রিক টন বর্জ্য হিসাবে ছড়িয়ে আাছে কৃষিক্ষেত্রে, রাস্তার পাশে, নালা-নর্দমায়, খাল-বিলে,নদ-নদীতে,সাগরে-
মহাসাগরে। এমনকি, হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্ট শৃঙ্গেও। প্লাস্টিক কিন্তু পচে না বা সহজে নষ্ট হয় না। শত শত বছর, এমনকি হাজার বছরেরও বেশি সময় অবিকৃত থেকে যায়। আবার প্লাস্টিক পোড়ালে প্লাস্টিক থেকে বিষাক্ত কিছু গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে । এইসব গ্যাসের মধ্যে আছে ডাই-অক্সিন, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড ইত্যাদি। এইসব গ্যাস ক্যানসার রোগ
সৃষ্টিতে বা এই রোগের বৃদ্ধিতে সহায়কের কাজ করে। আবার যেসব দ্রব্যের একক থেকে বিভিন্ন প্রকারের প্লাস্টিক দ্রব্য তৈরি হয়, সেইসব দ্রব্যও ক্যানসার রোগ সৃষ্টিতে বা ওই রোগ বৃদ্ধিতে সহায়কের কাজ করে। তাই প্লাস্টিক দিয়ে
তৈরি কোন আধারে খাবার বস্তু রাখা একেবারেই ঠিক নয়। যেসব প্লাস্টিক দ্রব্য জলে, স্থলে বর্জ্য হিসাবে ছড়িয়ে আছে, সেইসব
বর্জ্য থেকেও বিষাক্ত উপাদান ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। অথচ বিশ্বে এখন কোটি কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি হচ্ছে। ব্যবহারের পর তার বৃহৎ অংশই ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের সর্বত্র। অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
এখন যে হারে প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে ফেলা হচ্ছে, এই হার বজায় থাকলে আগামী পঁচিশ তিরিশ বছরে তার সংখ্যা সমুদ্রের জলজ প্রাণীর সংখ্যা থেকে বেশি হয়ে যাবে।স্থলভাগেও প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ দিন দিন বৃৃদ্ধি
পাচ্ছে। কি ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করে যাচ্ছি আমরা, বুদ্ধিমান মানুষেরা। গোটা মানবসমাজ যেন মূর্খ কালিদাসের ভূমিকায় নেমে পড়েছে সাময়িক সুখ ভোগ করার জন্য। গঠনগতভাবে প্লাস্টিক পচে না বা নষ্ট হয়ে যায় না। কিন্তু দীর্ঘদিন রৌদ্র
বা বৃষ্টিতে থাকলে, বিশেষ করে সূর্যদেহ থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে প্লাস্টিক কিন্তু ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এইসব টুকরো ছোট থেকে বড় সব মাপেরই হয়। যেসব টুকরো আকারে পাঁচ মিলিমিটার থেকে ছোট,সেইসব টুকরোকে মাইক্রো প্লাস্টিক বলা হয়। মাইক্রো প্লাস্টিকের একটি ভাগ আকারে এতই ছোট যে, খালি চোখে তাদের দেখাই যায় না। এইসব অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিকের টুকরো বিভিন্ন উপায়ে খাদ্যশৃঙ্খলে ও পানীয় জলে মিশে যায়। মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি বোতলবন্দি মিনারেল ওয়াটারেও পাওয়া যায়। এ এক বিপজ্জনক অবস্থা।আগেই বলা হয়েছে, প্লাস্টিক ক্যানসার রোগ সৃষ্টিতে বা এই রোগ বৃদ্ধিতে আরো সহায়ক হয়ে ওঠে। আরও কিছু রোগ সৃষ্টিতে বা বৃদ্ধিতেও প্লাস্টিকের ভূমিকা রয়েছে। শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, স্থলজ ও জলজ সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই তা সমানভাবে প্রযোজ্য। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় কিন্তু আজও পাওয়া যায়নি। আবার জলজ অনেক প্রাণী এসব প্লাস্টিকের টুকরো খাদ্য ভেবে ভুল করে খেয়ে নেয়। এই প্লাস্টিক কিন্তু কোনোভাবেই প্রাণীর হজম প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় না। ফলে তা প্রাণীদের দেহে আবিকৃত অবস্থায় থেকে যায় এবং যতদিন যায়, তার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে
থাকে। ফল হয় মারাত্মক। অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিমি বা ওই ধরনের বড় জলজ প্রাণী শুধু প্লাস্টিক, মাইক্রো প্লাস্টিকই নয়, ম্যাক্রো প্লাস্টিক বা আকারে পাঁচ মিলিগ্রাম থেকে শুরু করে অনেক বড় মাপের
হয়, খাদ্য ভেবে ভুল করে খেয়ে নেয়। ফলে একই পরিণতি ঘটে তাদের ক্ষেত্রেও।এমন ও দেখা গেছে প্লাস্টিক খেয়ে মৃত তিমি বা ওই জাতীয় বড় জলজ প্রাণীর পেটে দশ, বিশ বা তার থেকেও বেশি কেজি ওজনের প্লাস্টিক রয়েছে। আমাদের কারণে কী
মর্মান্তিক পরিণতি ঘটছে ওইসব অসহায় প্রাণীদের। অন্যদিকে, ব্যবহার করা মাছ ধরা জালের যে খ-াংশ সমুদ্রের পানিতে অবলীলায় ফেলে দেওয়া হয়, তাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, চলচ্ছক্তিহীন হয়ে তিমি, কচ্ছপ প্রভৃতি জলজ প্রাণী
একইভাবে মৃত্যুবরণ করছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সমুদ্রতলে কোনো কোনো অঞ্চলে কার্পেটের মত জড়িয়ে আছে প্লাস্টিকের ছোট বড় টুকরোগুলোই। ফলে শেওলা জাতীয় ক্ষুদ্র উদ্ভিদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই শেওলা খেয়েই ছোট মাছেরা জীবনধারণ
করে। আর ক্ষুদ্র মাছেদের খেয়ে বড় মাছেরা বেঁচে থাকে। ফলে মাছেদের বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হয়। মাছকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে মানুষ। ফলে মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমুদ্রের পানির কোরাল জগৎ সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি। কোরাল জগতের
মোহময় বর্ণবৈচিত্র, সৌন্দর্যপিপাসু মানুষদের মনকে সহজেই আকৃষ্ট করে। বিশ্বের উষ্ণম-লীয় অনেক দেশের সমুদ্রের পানিতে এই কোরাল জগৎ রয়েছে। কোরাল জগতের সৌন্দর্য উপভোগ কারার জন্য প্রতি বছর বিশ্বের হাজার হাজার পর্যটক কোরাল ক্ষেত্রগুলোতে ভিড় জমান। কোরাল জগৎ শুধু তার অপার সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত হয়ে ওঠেনি। কোরাল রিফ সমুদ্রের ঢেউ থেকে সমুদ্রোপকূলকে রক্ষা করার কাজেও সাহায্য করে। তাছাড়া কোরাল রিফ অসংখ্য জলজ প্রাণীর আবাসস্থলও বটে। তাদের জীবনচক্র কোরাল রিফকে আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে এবং এই রিফেই পূর্ণতা লাভ করে। অন্যান্যা কিছু কারণসহ সমদ্রের পানির প্লাস্টিকও এই কোরাল জগৎকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমনকি, কোনো কোনো অঞ্চলের কোরাল শ্রেণি ইতিমধ্যে হয় ধ্বংস হয়ে গেছে, নয়তো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের খ্যাতি বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে। এই রিফও আজ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক সমুদ্র পানির বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের সাথে বিক্রিয়া ঘটিয়ে কিছু বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে। এসব বিষাক্ত পদার্থই সংবেদনশীল কোরাল প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আরেকটি কারণ হল, সমুদ্র পানিতে
ভেসে চলা ছোট-বড় প্লাস্টিকের অসংখ্য টুকরো কোরাল শ্রেণিতে আটকা পড়ে যায়। এসব প্লাস্টিকের টুকরো দিনের পর দিন কোরালের গায়ে লেগে থাকে। শুধু পানিভাগেই নয়, স্থলভাগেও প্লাস্টিক নানাভাবে দূষণ ছড়িয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এই দূষণের ফলে মানুষসহ স্থলজ সকল প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে প্লাস্টিকের উপস্থিতি কৃষিজাত শস্যের ফলনে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
বর্ষার মরশুমে শহরাঞ্চলের নালা-নর্দমায় জমে থাকা প্লাস্টিক রাস্তায় পানি জমার কারণ হয়ে উঠছে। বর্ষব্যাপী নালা-নর্দমায়, রাস্তাঘাটে, বাড়ির আনাচে-কানাচে ফেলে রাখা প্লাস্টিকের গায়ে আটকে থাকা পানিতে মশার বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। বায়ুম-লেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইসব কণা শ্বাসক্রিয়ার সাথে জীবদেহে প্রবেশ করে জীবদেহের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে।
সাংবাদিক-কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার স্বর্ণপদক (১ম)