সোনালী ডেস্ক:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পঞ্চাশ বছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে তা সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রায় বৈপ্লবিক ঘটিয়েছে।
প্রযুক্তির নতুন নতুন ফসল এমনভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঢুকে পড়েছে যে নতুন প্রজন্মের মানুষ বিশ্বাস করতে পারবে না-এসব জিনিস পঞ্চাশ বছর আগে পৃথিবীতে ছিল না। এসব নতুন জিনিসের মধ্যে কম্পিউটার, টেলিভিশন, ইন্টারনেট কিছুটা পয়সাওয়ালা মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যে জিনিস গ্রামের গরীব মানুষ থেকে শহরের কোটিপতি সবার ঘরে প্রবেশ করছে তা হল বিভিন্ন ধরনের পলিমার বা প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি। পঞ্চাশ বছর আগে গরীব মানুষ ঘর তৈরী করত তালপাতা দিয়ে, বালতি বা পানির ট্যাঙ্ক হত টিন দিয়ে। পানির পাইপ তৈরি হত লোহা দিয়ে, বাজরে জিনিসপত্র বিক্রি হত কাঁচের বা টিনের কৌটায়। আসবাবপত্র বলতে কেবলমাত্র কাঠের আসবাব বোঝাত। আজ হতদরিদ্র মানুষের ঘরে সবচেয়ে সস্তার ছাউনি হচ্ছে প্লাস্টিকের শিট। যাদের টিনের বালতি কেনার পয়সা ছিল না তারা অনেক সস্তায় প্লাস্টিকের বালতি কিনছে। চামড়ার চটি কেনার সামর্থ্য নেই বলে যারা খালি পায়ে ঘুরে বেড়াত তাদের জন্য বাজারে এসেছে নানা ধরনের প্লাস্টিকের চপ্পল। গরীব এবং বড়লোক সবার গায়েই এখন আবিষ্কার পলিস্টারের জামাকাপড়। পানির ট্যাঙ্ক বা পাইপ তৈরী হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। বড়লোকদের বাড়ির দরজা-জানালা, আসবাবপত্রতৈরি হচ্ছে নানা ধরনের মোল্ডেড প্লাস্টিকের। ঘর সাজানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকের টাইলস, প্লাস্টিক পেইন্ট। কাঠের আসবাব ঢেকে দেয়া হচ্ছে নানা ধরনের সানমাইকা দিয়ে। বাজার থেকে কাঁচের শিশি, টিনের কৌটা, চটের থলি হটিয়ে সে জায়গায় এসেছে নানা ধরনের প্লাস্টিকের কৌটো বা পলিপ্যাক। ডেয়ারির দুধ বিক্রি হচ্ছে কাঁচের বোতলের বদলে প্লাস্টিকের পাউচ প্যাকেটে। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের প্লাস্টিকের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটছে। আজকাল স্যালাইন বা রক্তের জন্য কাঁচের বোতলের বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকের পাউচ। কৃত্রিম হার্ট ভাল্ব, কনট্যাক্ট ল্যান্স তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। পলিমার ব্যবহার করে সানশেড রিলিজ বলে এক নতুন প্রয়োগ পদ্ধতি বেরিয়েছে যার ফলে রোগীর রক্তে ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ ধরে ঔষধ মিলানো যায়। বিদ্যুতের কুপরিবাহী বলে এতকাল বৈদ্যুতিক সুইচ তারের উপরের আচ্ছাদন হিসেবে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার করা হত। অতি সম্প্রতি পরিবাহী প্লাস্টিক বলে একে নতুন ধরনের প্লাস্টিক আবি®কৃত হয়েছে যা বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে। ভাবতে অবাক লাগে এসব হয়েছে গত ৫০-৬০ বছরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে সেলুলয়েড আর ব্যাকেলাইট ছাড়া বিশেষ কোন প্লাস্টিক বাজারে ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত আগে পি ভি সি পলিথিন এবং নাইলন আবি®কৃত হয়। তারপর নিত্য নতুন প্লাস্টিকের অর্থ ‘অনেক’ এবং ‘মার’ মানে টুকরো বা খন্ড। যে কোন পলিমার অনু অনেকগুলোর এক-একটিকে বলে মনোমার (মনো এক)। উৎপাদন পদ্ধতি অনুযায়ী পলিমাদের দু’ভাগে ভাগ করা হয়। এক দলকে বলে অ্যাডিশন পলিমার, অন্য দলকে বলে কনডেনশেসন পলিমার। অ্যাডিশন পলিমারে মনোমার বা খন্ডগুলো জোড়া লাগাবার সময় তাদের থেকে কোন অংশ বেরিয়ে যায় না। কনডেনশেসন পলিমারে দুটি খন্ড জুড়বার সময় এক অণু পানি বা অন্য ছোট অণু বেরিয়ে যায়। ইথিলিন অণু জুড়ে যে অ্যাডিশন পলিমার হয় তার নাম পলিথিন। ইথিলিন অণুর পরমাণু বদলে একটা ক্লোরিন পরমাণু বসালে যে যৌগ তৈরী হয় তার প্রায় অর্ধেক হল পলিথিন। কনডেনশেসনে পলিমারের উদাহরণ হল বিভিন্ন ধরনের পলিস্টার টেরিলিন ইত্যাদি যা জামাকাপড়ে প্রয়োগের ফলে পৃথিবীতে পলিমার এবং প্লাস্টিকের উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ে। গত ৬০ বছরে পৃথিবীতে মোট পলিমার বা প্লাস্টিকের জনপ্রিয়তার মূল কারণ হল পানি বা বাতাসের সংস্পর্শে এর ক্ষয় হয় না। যে আবহাওয়ায় লোহার জিনিস রং না করলে কয়েক মাসে মরচে ধরে যায় সেখানে পলিথিন বা পি ভি সি-র জিনিস ২৫-৩০ বছর রং ছাড়াই অক্ষত থাকে। প্লাস্টিকে জিনিস একদিকে যেমন লোহার মত মজবুত অন্যদিকে হালকা এবং হাত থেকে পড়লে কাঁচের মত ভাঙ্গে না। মজবুত, হালকা, অভঙ্গুর, টেকসই এবং দামে সস্তা এতসব গুণের অধিকারী জিনিস তো জনপ্রিয় হবেই। পদার্থবিদ্যার ভাষায় প্লস্টিক শব্দের মানে হল এমন জিনিস যা আকারে সহজে পাল্টানো যায়। অণুর গঠন অনুযায়ী প্লাস্টিকের বৈজ্ঞানিক নাম পলিমার। তাপের প্রভাব অনুযায়ী পলিমারদের দু’ভাগে ভাগ করা হয়-থার্মাপ্লাস্টিক এবং থার্মোসেটিং প্লাস্টিক। থার্মোপ্লাস্টিক গরম করে গলানো যায় এবং সে গলানো প্লাস্টিক ছাঁচে ঢেলে ইচ্ছে মত বিভিন্ন জিনিস বানানো যায়। পলিথিন পি ভি সি ইত্যাদি থার্মোপ্লাস্টিক। থার্মোসেটিং প্লাস্টিকের অসুবিধা হল হল, একবার তা দিয়ে কোন জিনিস বানালে তা ভেঙ্গে তৈরী হয়ে গেলে তা আর গলানো যায় না। থার্মোসেটিং প্লাস্টিকের উদাহরণ ব্যাকেলাইট যা দিয়ে তৈরি হয়। থার্মোসেটিং প্লাস্টিকের অসুবিধা হল, একবার তা দিয়ে কোন জিনিস বানালে তা ভেঙ্গে গেলে বা অপছন্দ হলে সে প্লাস্টিক গলিয়ে নতুন কিছু করা যায় না। অর্থাৎ থার্মোসেটিং প্লাস্টিক পূর্ণব্যবহার বা রিসাইকল করা যায় না। এছাড়া থার্মোসেটিং যে কারখানায় তৈরি হয় সেখানে ছাঁচে বিক্রয় করে স্যুইচ ইত্যাদি যা দরকার তা করে ফেলতে হয়। কিন্তু এতে থার্মোপ্লাস্টিক তৈরীতেc ব্যবহার হয়। ইহা কলকারখানায় তৈরী করে দান আকারে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। যেমন ভারতে হলদিয়ায় তৈরি পলিথিনের দানা দিয়ে কলকাতায় বালতি, দুর্গাপুরে পানির পাইপ বানানো হয়। এছাড়া থার্মোপ্লাস্টিক গলিয়ে নতুন জিনিস তৈরী করা যায় বলে তার পূণর্ব্যবহার বা রিসাইকল করা সম্ভব। এ কারণে পলিথিন বা পি ভি সি-র মতা থার্মোপ্লাস্টিক এত জনপ্রিয়। যে কোন পলিমার তৈরী করতে লাগে মূলত মনোমার। এর সঙ্গে অবশ্য আরো কিছু জিনিস যোগ করতে হয় নানা কারণে। যেমন নানান রং ব্যবহার করা হয় রঙ্গিন প্লাস্টিক তৈরীর জন্য। পলিমারগুলো যখন গরম হয় তখন সে উত্তপ্ত পলিমার যাতে বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া না করে তার জন্য নানা রকম অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যোগ করা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় কোনটা খুব শক্ত, কোনটা খুব নরম। নমনীয়তা বাড়ানো-কমানোর জন্য যা ব্যবহার করা হয় তাকে প্লাস্টিসাইজার বলে। উপাদানের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশী হচ্ছে মনোমার। এ মনোমারগুলোর উৎস পেট্রোলিয়ম। পৃথিবীতে পেট্রোলিয়ামের ভান্ডার সীমিত হলেও পৃথিবীর মোট চাহিদা মিটাতে অতি সামান্য পরিমাণ পেট্রোলিয়ামের প্রয়োজন হয়। পশ্চিম ইউরোপে প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহার সত্ত্বেও সারা পশ্চিম ইউরোপে গাড়ির জ্বালানী, পলিমার ও অন্যান্য রাসায়নিক শিল্প ইত্যাদি সব মিলিয়ে যত পেট্রোলিয়াম খরচ হয়তার মাত্র চার শতাংশ অর্থাৎ পঁচিশ ভাগের এক ভাগ ব্যবহার হয় প্লাস্টিক তৈরী করতে। পি ভি সি-র মোট ওজনের অর্ধেকের বেশি হল ক্লোরিন যার উৎস খাদ্য লবণ যা পৃথিবীতে অঢেল। পেট্রোলিয়াম সংকট হলে পলিমার শিল্পের চেয়ে অনেক বেশী বিপদ হবে মোটর গাড়ির শিল্পে। মনে রাখতে হবে লিমার শিল্পে ছাঁচে ঢালাই করার সময় ১৫০ ডিগ্রি থেকে ২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতা লাগে। সব মিলিয়ে অবশ্য প্লাস্টিকের যেখানে লোহা বা অন্যান্য ধাতু বা কাঁচ গলাতে ৮০০ থেকে ১০০০ ডিগ্রি প্রয়োজন হয়। পলিমার শিল্পে তাই মোট শক্তি কাঠের পরিবর্তে পলিমার ব্যবহার পরিবেশ রক্ষায় অনেক সাহায্য করে। পলিমার ওজনে হালকা বলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহন করতে শক্তি কম খরচ হয়। আজকের শক্তি সঙ্কটের যুগে শক্তি সঞ্চয় একটা বিরাট ব্যাপার। এত গুণ সত্ত্বেও বেপরোয়া প্লাস্টিক ব্যবহার করার সময় কিছূ সতর্কতার প্রয়োজন আছে। প্লাস্টিকের আবর্জনা নিয়ে নানা অসুবিধা হচ্ছে। সাধারণত আমাদের বাড়িতে যেসব আর্বজনা হয় যেমন তরকারির খোসা, খাবারদাবার ইতাদি তা মাটিতে পুঁতে দিলে তা মাটির জীবাণুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে না। নোংরা\পলিপ্যাক ও অন্যান্য প্লাস্টিকের আবর্জনা নর্দমায় ফেললে নর্দমা বন্ধ হয়। মাটিতে পুঁতে দিলে মাটির উপরের পানি নিচের স্তরে যেতে পারে না। ফলে মাটির নিচের পানির স্তর নেমে যায়। এতে পানির সঙ্কট বাড়ে, ধ্বস নামার সম্ভাবনা বাড়ে। ইহা পানিতে ভেসে পানির অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এ কারণে প্লাস্টিক আবর্জনায় না ফেলে যথাসম্ভব পূনর্ব্যবহার করা উচিত। বাড়ির আবর্জনা প্লাস্টিক প্যাকেটে করে আস্তাকুড়ে ফেলা উচিত নয়। কারণ মাটির জীবাণু প্লাস্টিক প্যাকেট ভেদ করে আবর্জনার সঙ্গে মিশে বিক্রিয়া করতে পারে না। কাগজের ঠোঙা করে আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলা উচিত। কাগজ ভিজে গেলে ফুঁটো হয়। সে ছিদ্র দিয়ে মাটির জীবাণু ঠোঙার ভিতর প্রবেশ করে। এছাড়া নোংরা প্লাস্টিক পূণর্ব্যবহার বা রিসাইকল করা কঠিন হয়। তাই বাড়ির সমস্ত প্লাস্টিকের কৌটা বা ব্যাগ ধুয়ে মুছে খবরের কাগজের মত ফেরিওয়ালার কাছে কাছে বিক্রি করা উচিত যাতে বাজারে প্লাস্টিকের ব্যাগের পরিমাণ কমে তাই সরকার এখন আইন প্রণয়নের চিন্তা ভাবনা করছে। পূনর্ব্যবহার করা প্লাস্টিক বালতি ইত্যাদি বা খাবার জিনিস নয় এ রকম জিনিস বহন করতে ব্যবহার করা উচিত। এর কারণ পুর্নব্যবহার করা প্লাস্টিক বেশি রং এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ যোগ করা হয় যা বেশি ক্ষতিকারক। মনে রাখতে হবে পুকুর বা ডোবায় প্লাস্টিক ফেলে দিলে রিসাইকেল ব্যাগ মাত্রই রঙ্গিন স্বচ্ছ বা বর্ণহীন ব্যাগ দেখলে বোঝা যায় এর প্লাস্টিক রিসাইকল করা নয়। সরকার খাবারদাবারের জন্য শুধুমাত্র এ ধরনের ব্যাগ ব্যবহার করতে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। পলিমার শিল্পে রং, প্লাস্টিসাইজার, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ইত্যাদি হিসেবে যেসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় তাদের থেকে নানা রকম অসুখ হতে পারে। যদিও ইতিমধ্যে অনেকগুলো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের বদলে নিরাপদ বিকল্প আবিস্কৃত হয়েছে তবু খাবার জিনিসের জন্য যেসব প্যাকেট বা কৌটা ব্যবহার করা হয় সে সম্পর্কে সতর্কতার প্রয়োজন। এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থগুলো বিশেষ করে তৈল জাতীয় পদার্থ সহজে মিশে যায়। এ কারণে খাবার, গায়ে মাখার তেল এবং ডালডা জাতীয় পদার্থের প্যাকেট তৈরীর প্লাস্টিকে কেবলমাত্র নিরাপদ বা ফুডগ্রেড অ্যাডিটিভ ব্যবহার করা উচিত। তবে অহেতুক বেশি শঙ্কিত হবার কারণ নেই। পলিমার শিল্পে যা সমান্য পরিমাণ ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় তার থেকে অনেক বেশি রাসায়নিক পদার্থ আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত ঢুকছে। আজকাল চাষবাসে যেসব কীটনাশক পদার্থ ব্যবহার করা হয় তা অনেক বেশি মারাত্মক এবং প্রতিদিন খাবারদাবারের সঙ্গে এসব কীটনাশক আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। মোটরগাড়ীর ধোঁয়া থেকে ক্যান্সার, শ্বাসযন্ত্রের অসুখ, কিডনী বিকল ইত্যাদি নানা অসুখ হতে পারে। যে বিষাক্ত বাতাস আমরা নিঃশাসের সঙ্গে গ্রহণ করছি, যে বিষাক্ত খাবার আমরা প্রতিদিন খাচ্ছি তার তুলনায় পলিমার শিল্পে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ নিতান্ত তুচ্ছ। সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম
স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।