সোনালী ডেস্ক:
যতই ঝাঁ-চকচকে মল, আলোকোজ্জ্বল পথঘাট, রাতকে দিন করা মাঠে খেলাধূলা আমরা চালাচ্ছি ততই আরও বেশি করে আলোক দূষণের ফাঁদে জড়িয়ে
পড়ছি। আলোক দূষণ কথাটা শুনে কিন্তু অবাক হলে চলবে না। এই উজ্জ্বলতার মায়ায় যতই ডুবছি ততই বাস্তুতন্ত্রের পাকে চক্করে অস্তিত্ব সংকটের পথে চলে যাচ্ছি। বাস্তুতন্ত্র মানে হল গাছপালা থেকে শুরু করে অদৃশ্য জীব হয়ে দৃশ্যমান যত প্রাণী আছে তাদের সবার মধ্যে বয়ে চলা সম্পর্কের ঢেউ।
এই প্রাণ প্রবাহে আলোর শক্তি খুবই জরুরী কিন্তু অহেতুক আলোর অনুপ্রবেশ খুবই ক্ষতিকর। গাছপালা আর প্রাণীকূলের উপর সূর্যের আলোর যেমন, তেমনই কৃত্রিম আলোরও সরাসরি প্রভাব আছে। কিছু প্রজাতির মাকড়শা যেমন মোটেই আলো পছন্দ করে না আবার কয়েক প্রজাতির মাকড়শা সরাসরি বালবের পাশেই জাল বুনে রাখে। নিশাচর প্রাণীরা যেমন আলোর অবর্তমানে সক্রিয় থাকে তেমনই দিবাচর প্রাণীরা সক্রিয় থাকে আলোর উপস্থিতিতে। অর্থাৎ বোঝা যায় প্রাণী বা উদ্ভিদের সক্রিয়তার পেছনে সরাসরি আলোর উপস্থিতি কাজ করে। মানুষের ক্ষেত্রেও এই প্রভাব অবশ্যম্ভাবী ভাবে আছে। প্রথম যখন নিয়েনডারথাল মানুষেরা প্রায় পঁচিশ হাজার বছর আগে আগুন আবিষ্কার করে তখন থেকেই রাতেও কাজ করার অভ্যাসটা সে
রপ্ত করে। এখন বিদ্যুতিক আলোর হাত ধরে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ বা বিনোদন পর্ব চলে। শুধু কাজ করলে তো ভালোই ছিল । গোল বাঁধল যখন দেখা গেল শরীরের সিরকার্ডিয়ান ছন্দ নষ্ট হয়ে শুরু হল শারীরিক ও মানসিক স্ট্রেস। পৃথিবী সাড়ে বাইশ ডিগ্রি কোণে হেলে থাকার কারণেই ঋতু পরিবর্তন
আসে। ভুপৃষ্ঠে সূর্যালোকের উপস্থিতি ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া শারীরিক পরিবর্তনটাকে নষ্ট করে। আমাদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা চালনা করে মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাস অঞ্চল। দেখা গেছে অতিরিক্ত আলো এই তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে নষ্ট করে তার সক্রিয়তার সময়কেই বদলে দিচ্ছে। নীচূ আকাশে মেঘ থাকলে সবচেয়ে বেশি অন্ধকার থাকার কথা অথচ শহরে এই সময়টা আকাশ সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকছে। শহরের
রাস্তায় যত আলোর কিরণ তার যে অংশটা আকাশে চলে যাচ্ছে তা আকাশের মেঘে প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় ফিরে আসছে ভূপৃষ্ঠে। এই স্কাই গ্লো-র অনভিপ্রেত আক্রমণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কীটপতঙ্গ আর পাখির দল। কৃত্রিম আলোতে কীটপতঙ্গের পুঞ্জাক্ষী ধাঁধিয়ে যার বলে তারা আলোর উৎসের দিকে ছুটে চলে আর বাল্ববের গরমে পুড়ে মরে বা শারীরিকভাবে নিঃশোধিত হয়। স্কাই গ্লোর জন্য দিগভ্রান্ত হতে দেখা গেছে পরিযায়ী পাখিদের। দেখা গেছে আমেরিকার অত্যুচ্চ টাওয়ারগুলোতে আলোর সিগন্যালে দিগভ্রান্ত পাখীরা ধাক্কা খেয়ে মরছে। আমেরিকার বন্যপ্রাণী দফতরের মতে বছরে
এমন মৃৃত্যুর পরিমাণ প্রায় চার থেকে পাঁচ মিলিয়ন পর্যন্ত। এখানকার গ্রাউন্ড জিরো বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ধ্বংস¯তূপে যে দুটো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আলো জ্বলে সেই আলোর ফাঁদে পড়ে বছরে প্রায় দশ হাজারের মতো পাখিকে প্রাণত্যাগ করতে দেখা গেছে। সমুদ্রের পাড়ে ডিম পাড়ে যেসব কচ্ছপ বা টার্টল তাদের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে তারা সাধারণত সমুদ্রের দিকেই ছোটে কিন্তু দেখা গেছে সমুদ্রের পাড়ে থাকা হোটেলগুলোর আলোর টানে টার্টলের বাচ্চারা সমুদ্রের দিকে না-গিয়ে ছুটছে হোটেলের দিকে। স্বাভাবিক ভাবেই মরছে শত শত টার্টল শিশু। একটা ভীষণ বিপদের ঘটনা নিঃশব্দে হয়ে চলেছে পুকুর, নদীতে, খাঁড়িতে, সমুদ্রসহ সব ধরনের জলাশয়ে। আমরা টেরটি পর্যন্ত পাচ্ছি না। পানির জুপ্ল্যাংটন বা আণুবীক্ষণিক প্রাণী কণারা দিনের বেলা গভীর পানির অন্ধকারে থাকলেও রাতের সময় ভেসে উঠে। পানিতলে থাকা ফাইটোপ্ল্যাংটন বা আণুবীক্ষণিক শেওলা তাদের স্বাভাবিক খাবার।
এইভাবে পানির গভীরতায় চলে যাওয়া আবার উপরে ভেসে উঠার ব্যাপারটাকে বলে ডায়াল ভার্টিকাল মাইগ্রেশন। স্কাই গ্লো বেড়ে গেলে বা জলাশয়ের পাড়ে আলো জ্বালালে জুপ্ল্যাংটনের সংখ্যা যাচ্ছে বেড়ে আর অ্যালগাল ব্লুম হচ্ছে অর্থাৎ জলাশয়ে তখন মাছ, শামুক ইত্যাদি জলজ প্রাণীরা শ্বাস নিতে না-পেরে মরতে থাকে। জলাশয় একটা মৃত্যুপুরী হয়ে যায়। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে আলোক বর্ণালীর নীল আলো সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়। সাধারণ টিউব লাইট বদলে যদি সাদা খঊউ লাগানো হয় তবে আলোর মাত্রা কম ব্যবহৃত হলেও দূষণমাত্রা কিন্তু হবে অনেক বেশি, কারণ খঊউ আলোতে নীল
আলোর তরঙ্গ থাকে বেশি মাত্রায়। মানুষের চোখের আলোক সুবেদী কোষগুলো ওই নীল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে আঘাতে উত্তেজিত হলে সেই উত্তেজনা
মস্তিস্কের সঙ্গে যুক্ত পাইনিয়াল গ্রন্থির মেলাটোনিন ক্ষরণ বন্ধ করে দেয়। মেলাটোনিন খুবই শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। রক্তে মেলাটোনিন স্তন বা
প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ করে। এখন বেশি সময় ধরে আলোর প্রভাবে থাকায় আমাদের স্তন বা প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রবণতা বেড়ে গেছে। দেখা
গেছে টিউব লাইটের আলোয় মাত্র ঊনচল্লিশ মিনিটের মতো থাকলেই মোট মেলাটোনিন পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষরণ কমে গেছে। অতিরিক্ত আলোর দূষণে মাথাব্যথা এবং অবসাদ শেষে মানসিক বৈকল্য হতে দেখা যায়। রাতে যেসব ফুল ফোটে তাদের পরাগ সংযোগের জন্য দায়ী কীটপতঙ্গেরা। উজ্জ্বল
আলোর মায়ায় তার চারপাশেই ঘুরে মরছে, ব্যাহত হচ্ছে পরাগসংযোগ। উত্তর আয়ারল্যান্ডে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক ডার্ক স্কাই সিম্পোজিয়ামে
আলোর পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে আলোচনায় দেখা গেছে আলোর এই অবাঞ্ছিত আঘাতে পুরুষ দেহে কমছে শুক্রকীট উৎপাদন ক্ষমতা, বদলে যাচ্ছে জিনের গঠন। এছাড়াও ক্ষতি হচ্ছে চোখের রেটিনা স্তরে। শুনলে অবাক লাগবে আলোক দূষণ স্মগ (ধোঁয়া ও কুয়াশার মিশ্রণ) গঠন প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় অনেক গুণ। আমেরিকার জিওগ্রাফিক্যাল ইউনিয়ন আলোক দূষণের এই প্রভাব সম্পর্কে এক সমীক্ষা করেন। তারা দেখে যে, আলোক তরঙ্গের ধাক্কায় বাতাসে ভেসে আসা নাইট্রেটমূলক ভেঙে স্মগ তৈরির প্রবণতাও বাড়ছে।
সাংবাদিক-কলামিস্ট।